আমন শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘আমান’ থেকে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল (ঝঁৎব ঈৎড়ঢ়) বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। আবহমান কাল থেকে এ ধানেই কৃষকের গোলা ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণ-পোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকে। ২০১৮-১৯ আমন মৌসুমে দেশে ৫৬.২২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়, এর মধ্যে ৩.৩৯ লাখ হেক্টর বোনা, ৮.৭২ লাখ হেক্টর স্থানীয় জাতের এবং ৪৪.১১ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয় যা থেকে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৫৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে আমন আবাদ এরিয়া ৫% বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ৩.১৩ লাখ হেক্টর বোনা, ৮.৫১ লাখ হেক্টর স্থানীয় জাতের এবং ৪৭.১৯ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও প্রতিবছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে এবং গত বছর আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৫৫ লাখ টনে পৌঁছায়। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সঠিক নীতি কৌশল। এ বছর বোরো উৎপাদনের পর আউশ এবং আমনের উপর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। করোনার কারণে যেন খাদ্য সংকট না হয়, দেশে যেন দুর্ভিক্ষের মতো কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন খাদ্য কষ্টে না ভোগে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আমন ধান মূলত দুই প্রকার; রোপা আমন ও বোনা আমন। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজ তলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক- অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান কাটা হয়।বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বোনা আমনের বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে আছড়া আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। আমন মৌসুমে যেহেতু আবাদ আমনে আবাদ এলাকা বৃদ্ধির তেমন সুযোগ নেই তবে কিছু কিছু এলাকা যেমন;
১. সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক জমি পতিত থাকে তার মূল কারণ জমির মালিক বিদেশ থাকে (অনংবহঃবব ভধৎসবৎ);
২. নোয়াখালী ও বরিশালের চর অঞ্চল;
৩. যেসব এলাকায় আগাম সবজি চাষ করা হয় সেসব জমি পতিত না রেখে স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন ব্রি ধান৫৭, ৬২, ৭১, ৭৫ চাষ করা
৪. বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে আমন মওসুমে জমি পতিত না রেখে ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান৯১, অন্যান্য স্থানীয় জাত চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো-
জাত নির্বাচন : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমন মৌসুম ও এর পরিবেশ উপযোগী ৪১টি (৩৯টি ইনব্রিড ও ২টি হাইব্রিড) উফশী ধানের জাত ও ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা রকম কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করেছে। অনুক‚ল ও প্রতিক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য আমন জাতগুলো নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।
অনুক‚ল পরিবেশ উপযোগী জাতসমূহÑ
বিআর৪, বিআর৫, বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫।
প্রতিক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য জাত
* খরা প্রবণ এলাকায় ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭ ও ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১।
* বন্যা প্রবণ এলাকার জন্য উপযোগী জাতগুলো হলো- ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৯। এছাড়া বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬ জাতগুলোর নাবি গুণ থাকার জন্য এদের বীজ ২০-৩০ শ্রাবণে বপন করে ৩০-৪০ দিনের চারা সর্বশেষ ৩১ ভাদ্র পর্যন্ত বন্যা প্রবণ এলাকায় রোপণ করা যায়।
* লবণাক্ত এলাকায় বিআর২৩, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮।
* জোয়ার-ভাটা প্রবণ অলবণাক্ত এলাকার উপযোগী জাতগুলো হলো- ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৬,ব্রি ধান৭৭।
* জলাবদ্ধ এলাকার জন্য উপযোগী জাত- বিআর১০, বিআর২৩, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৮।
* বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে ব্রি ধান৯১ সহ গভীর পানিতে চাষাবাদ উপযোগী স্থানীয় জলি আমন ধান যেমন গোপালগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চলের ল²ী ও বাঁশিরাজ, সিলেট অঞ্চলে লালমোহন, হবিগঞ্জে দুধলাকি ও ফুলকুড়ি, ফরিদপুরে খইয়া মটর এবং সিরাজগঞ্জে সড়সড়িয়া।
* বরেন্দ্র এলাকার জন্য জাতগুলো হলো-ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫ ও ব্রি ধান৮০। এছাড়া সুগন্ধি ব্রি ধান৩৪ সহ সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলে অনুক‚ল পরিবেশের জন্য সুপারিশকৃত সব জাতই চাষ করা সম্ভব।
* পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযোগী জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, এবং ব্রি ধান৮০।
প্রিমিয়াম কোয়ালিটি জাত : দিনাজপুর, নওগাঁসহ যেসব এলাকায় সরু বা সুগন্ধি ধানের চাষ হয় সেখানে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭৫ ও ব্রি ধান৮০ চাষ করা যায়।
ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত : আমন মওসুমের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো ব্রি হাইব্রিড ধান৪ ও ৬। এ জাতগুলো বন্যামুক্ত এলাকায় রোপা আমনে অনুক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য। এ জাতগুলোর চাল মাঝারি চিকন, স্বচ্ছ ও সাদা এবং লম্বা, ভাত ঝরঝরে হওয়ায় কৃষকের কাছে পছন্দনীয়।
নতুন উদ্ভাবিত আমনের জাত ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০ এবং ব্রি ধান৮৭ জাতগুলো চাষ করে প্রতিনিয়ত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
বীজতলা তৈরি ও বীজ বপনের সময় : উঁচু এবং উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে যেখানে বন্যার পানি উঠার সম্ভাবনা নেই। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প জীবনকালের জাতের জন্য আলাদা আলাদা স্থান ও সময়ে বীজতলায় বপন করতে হবে। পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে নিম্ন, অতি নিম্ন অথবা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। ভালো চারা পাওয়ার জন্য ভালো বীজের বিকল্প নেই। তাই বিএডিসি, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বা ব্রি কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে ভালো বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে।
আমন বীজতলায় রোগ ব্যবস্থাপনা : আমন বীজতলায় বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। বাকানি রোগাক্রান্ত ধানের চারা স্বাভাবিক চারার চেয়ে হালকা সবুজ, লিকলিকে ও স্বাভাবিক চারার চেয়ে অনেকটা লম্বা হয়ে অন্য চারার ওপরে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত চারাগুলো ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আক্রান্ত চারার নিচের গিট থেকে অস্থানিক শিকড়ও দেখা যেতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা : বাকানি রোগ দমনের জন্য অটিস্টিন ৫০ ডবিøউপি বা নোইন ৫০ ডবিøউপি দ্বারা বীজ অথবা চারা শোধন করা (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটিস্টিন ৫০ ডবিøউপি বা নোইন ৫০ ডবিøউপি মিশিয়ে তাতে ধানের বীজ অথবা চারা ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা)। আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুঁড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজতলা হিসেবে একই জমি ব্যবহার না করা।
আমন বীজতলায় পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা : আমন বীজতলায় সাধারনত থ্রিপস এবং সবুজ পাতা ফড়িং পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা : বীজতলায় পানি কিংবা ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের মাধ্যমে থ্রিপস পোকার আক্রমণের তীব্রতা কমানো যেতে পারে। সবুজ পাতা ফড়িং পোকা দমনের জন্য হাতজাল কিংবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রমণের তীব্রতা খুব বেশি হলে উভয় পোকার ক্ষেত্রে ক্লোরপাইরিফস গ্রæপের কীটনাশক যেমন ডার্সবান২০ ইসি প্রতি বিঘায় ১৩৪ মিলি লিটার হারে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চারা রোপণ : লাইন বা সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সারি করে লাগালে ভালো। সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. (৮ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে। তবে জমি উর্বর হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখা যেতে পারে।
চারার বয়স
* আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতগুলোর চারার বয়স হবে ২০-২৫ দিন।
* আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর চারার বয়স হবে ১৫-২০ দিন।
* লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতগুলোর (যেমনঃ ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩) চারার বয়স হবে ৩০-৩৫দিন।
* আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলোর (যেমন- বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭) নাবীতে রোপণের ক্ষেত্রে চারার বয়স হবে ৩৫-৪০দিন।
রোপণ সময়
* রোপা আমনের আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে ১৫ জুলাই-১৫ আগস্ট। তাছাড়া প্রতিদিন বিলম্বের জন্য ফলন কমে যাবে।
* আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্প মেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে ২৫ জুলাই-২৫ আগস্ট। এই সময়ের আগে লাগালে ইঁদুর ও পাখি আক্রমণ করে।
* আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলোর (বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৫৪, নাইজারশাইল) বপন সময় হলো ৩০ আগস্ট পর্যন্ত এবং রোপণ সময় হচ্ছে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
* সকল সুগন্ধি এবং স্থানীয় জাত ১-২০ ভাদ্র সময়ের মধ্যে রোপণ করতে হবে।
সম্পূরক সেচ : আমন চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাত এক রকম হয় না। এমনকি একই বৎসরের একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বৃষ্টি-নির্ভর ধানের জমিতে যে কোনো পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে অবশ্যই সম্প‚রক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্প‚রক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাই সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ১. পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি যাতে বোরো মৌসুমের পর পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে তার ব্যবস্থা করা, ২. কৃষকের সেচ খরচে প্রণোদনা দেয়া।
সার ব্যবস্থাপনা : আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৬-৮-১৪-৯ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত ডিএপি/টিএসপি-এমওপি- জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সমান ভাগে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২০-৭-১১-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ১/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি/টিএসপি(লাল অংশ বা টিএসপি বাদ)-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমানভাগে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর এবং ২য় বা শেষ কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
নাবীতে রোপণকৃত আলোক-সংবেদনশীল জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৩-৯-১৩-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ২/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। ব্রি ধান৩২ এবং স্বল্প আলোক-সংবেদনশীল সুগন্ধিজাত ধানের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ১২-৭-৮-৬ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে।
* ডিএপি সার ব্যবহার করলে সবক্ষেত্রেই প্রতি কেজিতে ৪০০গ্রাম ইউরিয়া কম ব্যবহার করলেই হবে। ঘওচ উপাদানের মধ্যে ঝুহবৎমরংঃরপ বা অতিপ্রভাব বিদ্যমানের ফলে ধান গাছ মাটি থেকে অধিক পরিমাণ ঘ আহরণের পাশাপাশি চ আহরণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ফলে ধান গাছের কুশি উৎপাদন, দানার গঠন ও পরিপুষ্টতা ত্বরান্বিত হয়। এতে গাছ শক্ত হয় এবং রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ফলশ্রæতিতে আমনের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
সাশ্রয়ী সার ব্যবহারে কয়েকটি প্রযুক্তি
আমরা জানি, উদ্ভিদের নাইট্রোজেন এর অভাব পূরণে জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের জৈব সার (যেমন-সবুজ সার, আবর্জনা পচা সার, পচা গোবর), নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়াল ইনোকুলাম প্রয়োগ এবং অ্যাজোলার চাষ বাড়ানো যেতে পারে। ব্রি’র তথ্যমতে, দুই সেমি. পর্যন্ত পানিযুক্ত কাদা মাটিতে গুটি ইউরিয়া ও প্রিল্ড ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। তবে জোয়ারভাটা অঞ্চলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। অন্যদিকে ডাই এমোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব। জিংক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) সার ফসফরাস জাতীয় সারের সঙ্গে একত্রে ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানে জিংক সারের সর্বশেষ প্রযুক্তি চিলেটেড জিংক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল জিংক স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব।
আগাছা ব্যবস্থাপনা : ধানক্ষেত ৩৫-৪০ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে এবং আগাছানাশক ব্যবহার করে আগছা দমন করা যায়। রোপা আমন ধানে সর্বোচ্চ দুইবার হাত দিয়ে আগাছা দমন করতে হয়। প্রথম বার ধান রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে ধানের দু’সারির মাঝের আগাছা দমন হয় কিন্তু দু’গুছির ফাঁকে যে আগাছা থাকে তা হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যান্ত্রিক দমনে অবশ্যই সারিতে ধান রোপণ করতে হবে। আগাছানাশক ব্যবহারে কম পরিশ্রমে ও কম খরচে বেশি পরিমাণ জমির আগাছা দমন করা যায়। প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৩-৬ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর আগে) এবং পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর পর) ব্যবহার করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকলে ভালো। আমন মৌসুমে আগাছানাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। তবে আগাছার ঘনত্ব যদি বেশি থাকে তবে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪৫ দিন পর হাত নিড়ানি প্রয়োজন হয়।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা : নিবিড় চাষাবাদ ও আবহাওয়াজনিত কারণে আমনে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এলাকাভেদে আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সাদা পিঠ গাছফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষষণায় দেখা যায় যে, রোপা আমন মৌসুমে ধানের চারা রোপনের পর ৩০ দিন কীটনাশক ব্যবহারে বিরত থাকলে যে সমস্ত উপকারী পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেগুলো ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং এর ফলে ক্ষতিকর পোকার অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রার দ্বারপ্রান্তের নিচে থাকে। ফলে সমস্ত মৌসুমে পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না কিংবা একবার মাত্র প্রয়োগ করলেই চলে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকা দমন করলে রোপা আমন মৌসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে।
ধানক্ষেতে ডালপালা পুতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতাফড়িং ্ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়। উল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পোকার আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলে মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য কার্টাপ গ্রæপের যেমন- সানটাপ ৫০পাউডার প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে অথবা যে কোনো অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য ভিরতাকো ৪০ ডবিøউজি প্রতি বিঘায় ১০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। বাদামি গাছফড়িং ও সাদা পিঠ গাছফড়িং দমনের জন্য মিপসিন ৭৫পাউডার প্রতি বিঘায় ১৭৫ গ্রাম, পাইমেট্রোজিন ৪০ডবিøউজি ৬৭গ্রাম, ডার্সবান ২০ইসি ১৩৪ মিলি হারে ব্যবহার করতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল ৮৫পাউডার অথবা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা : আমন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, বøাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাকানি, এবং ল²ীরগু (ঋধষংব ঝসঁঃ) সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপ‚র্ণ রোগগুলো হল খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, বøাস্ট, টুংরো, বাকানি এবং ল²ীরগু রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দু'কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ফলিকুর, নেটিভো, এবং স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
এ মৌসুমে সকল সুগন্ধি ধানে নেক বøাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে থোড় আসার শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক যেমন ট্রুপার অথবা নেটিভো ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দুই একটি গাছে টুংরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগের বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং উপস্থিতি থাকলে, হাতজালের সাহায্যে অথবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতা ফড়িং মেরে ফেলতে হবে। হাত জালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতা ফড়িং পাওয়া যায় তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক, যেমন মিপসিন, সপসিন এবং সেভিন অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। ল²ীরগু দমনের জন্য (বিশেষ করে ব্রি ধান৪৯ জাতে) ফুল আসা পর্যায়ে বিকাল বেলা প্রোপিকোনাজল গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন- টিল্ট (১৩২ গ্রাম/বিঘা) সাত দিন ব্যবধানে দুই বার প্রয়োগ করা।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ : শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝড়ে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্বাইন হার্ভেস্টার ও মিনি কম্বাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
ধানের বীজ সংরক্ষণ : ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। আমন মৌসুমে নিজের বীজ নিজে রেখে ব্যবহার করাই উত্তম। এ কথা মনে রেখেই কৃষক ভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালোভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে।
0 Comments